টুনটুনি ও কুনোব্যাঙ — বাংলা শিশু সাহিত্যে নিঃসন্দেহে একটি অনবদ্য সংযোজন। শুধু গল্পপাঠের আনন্দই নয়, এর মধ্যে যে নীতি-নৈতিকতার বার্তা, গল্পের নির্মাণশৈলী, এবং ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত নানা পর্যায়ের আচরণ ও তার প্রতিক্রিয়ার চমৎকার মেলবন্ধন রয়েছে—তা একদিকে আনন্দদায়ক, অন্যদিকে গভীরভাবে চিত্তাকর্ষক।
আমরা এই গল্পটি প্রথম পড়েছিলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, সম্ভবত চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণিতে। তখনকার বয়সে এমন একটি গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করার মতো চিন্তার গভীরতা বা বোধের পরিপক্বতা আমাদের ছিল না। ফলে গল্পটা পড়েছিলাম শুধুই নির্মল আনন্দের জন্য। কিন্তু তখনকার সেই পড়া গল্পটি আমাদের শিশুমনে এমন দাগ কেটেছিল যে, এত বছর পরেও সেই স্মৃতি ভুলিনি।
সেই শৈশবের মুগ্ধতাকেই আবার খুঁজে পেতে, বহুদিন পর এই গল্পটা আবার হাতে তুলে নিয়েছি। ফিরে গিয়েছি সেই ছোটবেলার সরল ভালোবাসায়। আর এবার চেষ্টা করেছি সম্পূর্ণভাবে বুঝে নিতে—গল্পটা কী বলতে চায়, কী শেখায়, এবং বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন কেমন হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – “পুরাতন প্রেম, নিত্য-নূতন সাজে“।
যাক, বেশি কথা না বাড়িয়ে এবার ফিরে যাই মূল গল্পে।
মূল গল্প
অনেকদিন আগের কথা। পাহাড়ের ঢালে ঝরনার ধারে গর্তে থাকত এক কুনোব্যাঙ। তার পাশে শিম লতার ঘন ঝোপ। ঝোপের ধারে কুলগাছে বাসা বেঁধেছিল একটি টুনটুনি। ব্যাঙ আর পাখির মধ্যে খুব ভাব।
একদিন শহর থেকে ঘুরে এল কুনোব্যাঙ। শহর থেকে ফিরেই সে টুনটুনিকে ডাকল। বলল, ও টুনটুনি, শুনছ? শহরের লোকেরা বলছিল, আসছে শনিবার নাকি খুব ঝড় হবে।
ঝড়ের কথা শুনে টুনটুনি খুব ভয় পেল। এখন উপায়? ব্যাঙের মনে তেমন ভাবনা নেই । সে টুনটুনিকে বলল, আমার গর্ত আছে। ঝড় এলে গর্তে লুকাব। কিন্তু তোমার কী হবে?
কুনোব্যাঙ বানিয়ে বানিয়ে কথা বলত। ঝড়ের কথাও সে বানিয়ে বলেছিল। আসলে শহরে এ নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। মিথ্যা বলে ভয় দেখানোই তার স্বভাব। টুনটুনি ছিল খুব ভীতু। ঝড়ের কথা শুনে ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেল ।
শনিবার সকাল থেকে আকাশে মেঘ করেছে। এক সময় মেঘ ডেকে উঠল। ভয়ে টুনটুনির বুকটা দুরুদুরু করে উঠল। ছুটতে ছুটতে সে গিয়ে বসল মস্ত বড় এক চিবিদ গাছের মগডালে । পাহাড়ের উঁচুতে চিবিদ গাছ ডালপালা মেলে আছে। সেই গাছে থাকত এক রংরাং পাখি । আগের দিনে চিবিদ গাছে রংরাং পাখিরা বাসা বাঁধত। রংরাং পাখিটা তখন গাছের ডালে বসে হাঁ করে হাওয়া খাচিছল।
টুনটুনি রংরাং পাখির ঠোঁটের সেই ফাঁকটিকে গর্ত ভেবে তার ভেতরে ঢুকে পড়ল ।
চমকে উঠল রংরাং পাখি। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল। ভয়ে টুনটুনি বাইরে বেরিয়ে এল।
গাছের নিচে ঘাস খেয়ে বেড়াচিছল এক হরিণ। রংরাং পাখির চিৎকারে ভয় পেয়ে সে দিল ভোঁ- দৌড়। বনের ধারে বিশ্রাম নিচ্ছিল এক মস্ত বড় অজগর সাপ। হরিণের খুর লাগল তার লেজে। লেজের ব্যথায় সে কোঁকাতে থাকল। তারপর মাথা তুলে সামনে দেখতে পেল এক পিঁপড়ের বাসা। অজগর পিঁপড়ের বাসায় দিল এক ধাক্কা। সেই ধাক্কায় পিঁপড়ের বাসা ভেঙে তছনছ হয়ে গেল ।
পিঁপড়ের সর্দার ছিল বেজায় রাগী। সে রাগের মাথায় হাতির শুঁড়ে কুটুস করে এক কামড় বসিয়ে দিল। এক ঝাড় কলাগাছ খেয়ে হাতিটা তখন জিরিয়ে নিচ্ছিল। রেগেমেগে সে উঠে দাঁড়াল। পিঁপড়ে ততক্ষণে পালিয়েছে। পিঁপড়েকে ধরতে সে পা বাড়াল। সেখানকার চাষিরা পাহাড়ের ঢালে জুম চাষ করত। হাতির সামনে পড়ল এক জুম খেত! সেই জুমে ধান বুনেছিল এক বুড়ি। বুড়ির ছেলেমেয়ে কেউ নেই। অনেক কষ্টে সে একা একা ধান বুনেছে। হাতিটা বুড়ির কষ্টের ফসল সাবাড় করতে শুরু করল। তা দেখে দুঃখে বুড়ি কেঁদেই ফেলল। সে বিচার চাইতে গেল রাজার কাছে।

বুড়ির কথা শুনে রাজা তো রেগে আগুন । তার রাজ্যে এত বড় অন্যায়? রাজা হাতিকে ডেকে পাঠালেন । রাজার হুকুম পেয়ে হাতি এল রাজ-দরবারে। রাজাকে সালাম করল শুঁড় তুলে। রাজা রেগে বললেন, হাতি, তোমার এত সাহস? তুমি বুড়ির জুম ধান সাবাড় করেছ ? হাতি বলল, মহারাজ, এক পাজি পিঁপড়ে আমার শুঁড়ে কামড়ে দিয়েছে। আর তাই আমি রাগ করে বুড়ির ধান খেয়ে ফেলেছি। শুঁড়ের ব্যথায় মরছি। কাঁদতে গেলে চোখের পানিতে শুঁড় যায় ভিজে। তাই ভালো করে কাঁদতেও পারি না, মহারাজ।
রাজা মহাভাবনায় পড়লেন। ঠিকই তো শুঁড়ে ব্যথা হলে হাতির কি হুঁশ থাকে? রাজা হুংকার ছেড়ে বললেন, পিঁপড়েটাকে ডেকে পাঠাও। পিলপিল পায়ে পিঁপড়ে এসে হাজির হল। সে বলল, মহারাজ, আপনি কাটলেও কাটতে পারেন, মারলেও মারতে পারেন। আমার কোন কসুর নেই ।
রাজা পিঁপড়েকে ধমক দিয়ে বললেন, একটুকু জীব তুমি, তোমাকে কাটার জায়গা কোথায়? তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাব ।
পিঁপড়ে তখন ভয়ে ভয়ে বলল, অজগর আমার বাসা ভেঙে দিয়েছে। তাই আমি হাতির শুঁড় কামড়ে দিয়েছি।
রাজার হুকুমে কাটা লেজ নিয়ে হাজির হল অজগর । সে রাজাকে তার কাটা লেজটা দেখাল ।
লেজের দুঃখে সে পিঁপড়ের বাসা ভেঙে দিয়েছে। রাজাকে সে বলল, আপনার লেজ নেই। লেজের কষ্ট আপনি বুঝবেন কী করে?
নিজের লেজ নেই বলে মহারাজ লজ্জা পেলেন । হুংকার ছেড়ে বললেন, হরিণকে ডাক ।
হরিণ এল । রাজাকে কুর্নিশ করে বলল, মহারাজ, রংরাং পাখির কাণ্ড শুনুন । সে ভীষণ জোরে চিৎকার করছিল। আমি তাই ভয়ে দৌড়াতে থাকি। আমার খুর লেগে অজগরের লেজ কেটেছে, একথা বুঝতেই পারিনি ।
রাজার হুকুমে রংরাং পাখি তার বিরাট ডানা মেলে দরবারে এল। তারপর সে বলল, মহারাজ, ছোট্ট টুনটুনিটা আমার ঠোঁটের ফাঁকে ঢুকে পড়ল। আর তাই আমি চমকে উঠে চিৎকার শুরু করি । দোষ কী আমার?
টুনটুনি এল। সে ভয়ে চুপসে গেল। কাঁচুমাচু করে সে বলল, মহারাজ, তখন আমি ভুল করে রংরাং পাখির মুখে ঢুকে পড়েছিলাম। কুনোব্যাঙ আমাকে মিথ্যে ভয় দেখিয়েছে । রাজা টুনটুনিকে ধমক দিয়ে বললেন, আমার রাজ্যে ভয় কিসের?
রাজা মিথ্যা বলা মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি মিথ্যাবাদী কুনোব্যাঙকে ডেকে পাঠালেন ।
কুনোব্যাঙ কি সহজে ধরা দেয়? রাজার আদেশ শুনে সে ঢুকে পড়ল গর্তে। রাজার পেয়াদা খুঁজে বের করল কুনোব্যাঙকে । পা ধরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এল ।
কুনোব্যাঙকে দেখে রাজা বাজখাঁই গলায় বললেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। মিথ্যা বলা বড় অপরাধ । তোমাকে কঠিন শাস্তি দেব ।
কুনোব্যাঙ নিজের দোষ স্বীকার করল। সে হাতজোড় করে রাজার কাছে ক্ষমা চাইল । আর কখনও সে মিথ্যা কথা বলবে না।
রাজার মনে দয়া হল। তিনি কুনোব্যাঙকে প্রাণে মারলেন না। তবে মিথ্যা বলার জন্য শাস্তি তাকে পেতেই হবে । কুনোব্যাঙকে তিনি পঁচিশ ঘা বেত মারার হুকুম দিলেন। রাজার হুকুমে কুনোব্যাঙকে কাঁঠাল গাছের সাথে বাঁধা হল। তারপর পেয়াদা তাকে বেত মারতে শুরু করল। যতই বেত মারা হয় ব্যাঙ ততই ফুলতে তাকে। তার গা থেকে বেরিয়ে আসে সাদা সাদা আঠা। বেতের বাড়ি খেয়ে তার শরীর দাগে ভরে গেল। তারপর থেকে ব্যাঙের শরীরের চামড়া হল খসখসে। আর কাঁঠাল গাছ একটু কাটতেই বেরিয়ে আসে সাদা রঙের আঠা। [চাকমা রূপকথা]
আলোচনা এবং নৈতিক শিক্ষা
“টুনটুনি ও কুনোব্যাঙ” গল্পটি একটি বর্ণময় রূপকথা, যার গভীরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা। এই গল্প শিশুদের জন্য নৈতিক শিক্ষা বইয়ে স্থান পাওয়ার যোগ্য, এবং প্রযোজ্য হলে এটি গল্পাভিনয়, পাঠচক্র, এমনকি মনস্তাত্ত্বিক আলোচনার ক্ষেত্রেও ব্যবহারযোগ্য।
নীতিশিক্ষা:
গল্পটির মূল নীতিশিক্ষা হলো:
✅ মিথ্যা বলা বড় অপরাধ। মিথ্যা ছড়িয়ে দিলে তার ভয়াবহ প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সাথে আরও কিছু গঠনমূলক বার্তা পাওয়া যায়:
- অহেতুক ভয় দেখানো বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
- একজনের ভুল থেকে পুরো সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- রাজা বা নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তির উচিত বিচক্ষণতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা।
- ক্ষমা চাইলেও অন্যায়কারীর শাস্তি হওয়া উচিত যাতে সমাজে সতর্কতা থাকে।
- বিচারব্যবস্থা কেবল শাস্তিমূলক নয়, বরং নৈতিক শিক্ষা দিতেও সক্ষম হওয়া উচিত।
গল্প বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা:
১. কাহিনির বুনন ও বিস্তার:
গল্পটি একটি ছোট্ট মিথ্যা থেকে কীভাবে বিশাল এক শৃঙ্খলা-ভঙ্গ ঘটতে পারে, তার চমৎকার উদাহরণ। টুনটুনির ভীতির শুরু থেকে শুরু করে তা রংরাং পাখি → হরিণ → অজগর → পিঁপড়ে → হাতি → বুড়ি → রাজা পর্যন্ত গড়িয়েছে — এটি অসাধারণ গল্প নির্মাণ কৌশল।
২. চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ:
- টুনটুনি: সহজ-সরল ও ভীতু।
- কুনোব্যাঙ: মিথ্যাবাদী, কল্পনাবিলাসী।
- রংরাং পাখি, হরিণ, অজগর, পিঁপড়ে, হাতি: সবাই ছিলো পরিস্থিতির শিকার, যারা একে অপরের প্রতি পরোক্ষভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে।
- রাজা: ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু বিচারক।
৩. সমাজ ও শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্ব:
গল্পটি শিশুদের জন্য উপযুক্ত হলেও, এর গভীর শিক্ষা বড়দের জন্যও প্রাসঙ্গিক। এক ব্যক্তির মিথ্যা থেকে কীভাবে পুরো পরিবেশ প্রভাবিত হয় — এটি নেতৃত্ব, সমাজ, রাজনীতি কিংবা সাধারণ জীবনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ বহন করে। গল্পটি মনে করিয়ে দেয় যে, “মিথ্যার প্রভাব শুধু একজনকে নয়, পুরো সমাজকে ব্যথিত করতে পারে।”
৪. ভাষা ও গল্প বলার ধরণ:
গল্পের ভাষা সহজ, প্রবাহমান, এবং স্বভাবজাত রসিকতা ও নাটকীয়তা রয়েছে। এতে শিশুরা যেমন মজা পাবে, তেমনি শিক্ষাও পাবে। গল্পের শেষে ব্যাঙের গায়ের চামড়ায় দাগ আর কাঁঠাল গাছের আঠা নিয়ে যে রূপক তৈরি করা হয়েছে, তা লোককথার বিশুদ্ধ রস ও কল্পনার শক্তি প্রদর্শন করে।