আজ ২২ শ্রাবণ, বাংলা সাহিত্যের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। ১৯৪১ সালের এই দিনে, কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে চিরবিদায় নেন এই মহামানব। তাঁর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বিশ্বসভ্যতা এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র একজন কবি ছিলেন না; তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতস্রষ্টা ও দার্শনিক। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা তাঁর হাত ধরেই। তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা ছিল কোনো এশীয়র প্রথম নোবেল জয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি শুধু বাংলা ভাষাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তাঁর কাব্য ও দর্শনের আবেদন ছিল সর্বজনীন। তাঁর গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে, শুধু ভারতেই নয়—বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতও তাঁরই রচনা। এমন কীর্তিমান মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই জন্মেছেন।
২২ শ্রাবণের বিষণ্নতা: কবিগুরুর প্রয়াণে থমকে থাকা বাংলা
২২ শ্রাবণ। বর্ষার একদিন, বাতাসে সোঁদা গন্ধ আর শ্রাবণের শ্রুতি। এই দিনটি কেবল একটি তারিখ নয়, বাঙালির হৃদয়ে এক চিরন্তন বিষাদের নাম। এদিনেই ১৯৪১ সালে বিদায় নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ স্থপতি, বিশ্বমানবতার কণ্ঠস্বর — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
২২ শ্রাবণ যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কেবল একজন মানুষ নয়, এক যুগের অবসান হয়েছিল সেই দিন। তবে রবীন্দ্রনাথের দেহ হয়তো নেই, কিন্তু তাঁর অমর সৃষ্টি আজও বেঁচে আছে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে, চিন্তাভাবনায়, সংস্কৃতিতে।
এই দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমাদের রবীন্দ্রনাথকে—যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গর্ব, এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন প্রেরণা।
শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন এক সত্তা, যিনি শব্দ দিয়ে সময়কে রচনা করতেন, গান দিয়ে ইতিহাসকে গেঁথে রাখতেন, চিত্রে প্রকাশ করতেন অন্তর্জগতের আলো-আঁধারি।
মৃত্যুর মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ: এক মহাকাব্যিক বিদায়
জীবনের শেষ দিনগুলোতে কবি অসুস্থ হলেও তাঁর কলম থেমে ছিল না। মৃত্যুর আগের দিনগুলিতে, তিনি রচনা করেন তাঁর শেষ কবিতা, যেখানে মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি / বিচিত্র ছন্দে গাথা তোমার জীবনগাথা।” এমন সাহসী, এমন কোমল মৃত্যুবরণ বাঙালি আর কখনও দেখেনি।
তিনি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে, দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে। রাখীপূর্ণিমার সেই দিনে রবীন্দ্রনাথের প্রস্থান যেন প্রকৃতির নিজেরই এক গভীর কাব্য হয়ে উঠেছিল।
শ্রাবণ তার ছায়া ফেলে…
২২ শ্রাবণ মানেই গানের সুরে বিষণ্নতা, আবৃত্তির কণ্ঠে কান্না। ছায়ানট, বাংলা একাডেমি, শান্তিনিকেতন কিংবা সাধারণ ঘরের ছাদেও এই দিনে রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসেন — স্মৃতির অবগাহনে, গান-গল্প-কবিতার আলোয়। তাঁর গাওয়া সেই চিরচেনা গান যেন আরও গভীর হয়ে ওঠে এই দিনে —
“আমার এ পথ চাওয়াতেই আনন্দ, / আমি যদি আর না আসি…”
এই একদিন যেন বাঙালির নিজস্ব “বিদায় বেলা” — এক তরঙ্গ যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
কেন তিনি চিরন্তন?
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর বাংলা সাহিত্য এত সমৃদ্ধ হয়েছে সত্য, কিন্তু তাঁর শূন্যতা পূরণ হয়নি। কারণ তিনি শুধু সাহিত্যের কারিগর ছিলেন না, ছিলেন এক সমগ্র দার্শনিক দর্শন।
- তাঁর সাহিত্যে রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্য, জীবনের জটিলতা, মৃত্যুর মাধুর্য।
- তাঁর গানে প্রেম, প্রকৃতি ও পরমতত্ত্ব মিলেমিশে এক অপূর্ব নান্দনিক বোধ তৈরি করে।
- তাঁর জীবনচর্যা ও শিক্ষাদর্শনে রয়েছে মানবতাবাদের স্বচ্ছ ধারা।
শেষের কবি, শুরুদের অনুপ্রেরণা
আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথ নেই, কিন্তু রবীন্দ্রসত্তা আমাদের মধ্যেই আছে —
- ঘুমানোর আগে যিনি গুনগুন করে গাই, “আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে”
- বিপদে-আপদে যার পঙ্ক্তি মনে পড়ে, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে”
- কিংবা ভালোবাসায়, “বাজে কার বীণা…” শুনে চুপ করে থাকি।
রবীন্দ্রনাথ নেই, কিন্তু তিনি আছেন — আমাদের চেতনায়, আমাদের প্রেমে, আমাদের প্রতিরোধে।