হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা

হ্যামেলিনের বাঁশীওয়ালা

সে এক আদ্যিকালের কথা।

জার্মানির একটি ছোট শহর। নাম তার হ্যামেলিন। শহরের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে একটি নদী। শহরের অদূরে মাথা উঁচু করে আছে পাহাড়ের সারি। দূর থেকে দেখলে সেসব পাহাড়কে ধূসর আর নীল মনে হয়।

ছবির মত সুন্দর শহর হ্যামেলিন। গাছপালার ছায়ায় ঢাকা শহরের পথঘাট। রাস্তার মোড়ে মোড়ে রঙিন পানির ফোয়ারা। সবই ছিল হ্যামেলিনে, শুধু মানুষের মনে শান্তি ছিল না। নিশ্চিন্ত মনে কেউ খেতে শুতে পারত না।

পারবে কী করে? সারা শহর জুড়ে লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে ইঁদুর। ইঁদুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ শহরের লোকজন। ঘরের খাবারদাবার তারা সাবাড় করছে। কুচিকুচি কাপড়চোপড় আর বইপত্র। ঘুরে বেড়াচ্ছে যখন যেখানে খুশি। বিড়ালগুলো আগেই শহর ছেড়ে পালিয়েছে। ইঁদুরেরা বিড়ালের ছোট বাচ্চাগুলো খেয়ে ফেলছে। আর এখন দল বেঁধে তাড়া করছে কুকুরদের। ইঁদুরেরা ছোট ছেলেমেয়েদের হাত থেকে খাবার কেড়ে খাচ্ছে, তাদের আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছে। চারদিকে শুধু ইঁদুর আর ইঁদুর।

কেবল খাবার খেয়ে আর বইপত্র কেটে যদি ইঁদুরেরা শান্ত থাকত তাহলে কথা ছিল না। তাদের চেঁচামেচিতে লোকের কান ঝালাপালা হয়ে গেল। দাপাদাপি করে আর জিনিসপত্র ছড়িয়ে ইঁদুরেরা মানুষকে রাতেও ঘুমাতে দিচ্ছে না। তাদের উৎপাতে কোথাও শান্তি নেই।

হ্যামেলিনের লোকজন ইঁদুর তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে গেল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ইঁদুরের উৎপাত চলল সমান তালে। দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে লোকজন দুর্বল হয়ে পড়ল। দুশ্চিন্তায় সবাই ভীত সন্ত্রস্ত। ইঁদুর বুঝি তাদের ঘরছাড়া দেশছাড়া করবে।

সেদিন সভা বসল পৌরভবনে। মেয়র সভা ডেকেছেন! শহরের রুই কাতলারা এসে গেছেন। সলাপরামর্শ চলছে কী করে ইঁদুরের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। সভাকক্ষের বাইরে একত্র হয়েছেন অধৈর্য নগরবাসী। সবাই চিন্তা করছেন, কিন্তু কেউ কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। হঠাৎ দরজায় করাঘাত শোনা গেল – ঠক্ ঠক্ । আবার কে এল ?

ভেতরে এস। জোরে বললেন মেয়র।

ঘরের ভেতর ঢুকল এক অদ্ভুত মানুষ। তার পোশাক আর চেহারা দেখে সবার চোখ কপালে উঠল। লোকটি বেঢপ লম্বা আর লিকলিকে দেখতে। গায়ে ঢিলেঢালা রং-বেরঙের আলখাল্লা, মাথায় লম্বা টুপি। আর কাঁধে বড়সড় ঝোলা। ঠিক যেন গল্পের ছেলেধরা। কিন্তু তার চোখ দুটি ভারি সুন্দর, উজ্জ্বল নীল রঙের। মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে কিম্ভূতকিমাকার সেই লোকটি মেয়রকে সালাম ঠুকল।

লোকটির দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে মেয়র বললেন, কী চাই তোমার?

শহরের ইঁদুরগুলোকে আমি এক মুহূর্তে দেশছাড়া করতে পারি।— শান্ত সুরেলা গলায় লোকটি উত্তর করল।

ঠোঁট বাঁকিয়ে মেয়র বললেন, তাই নাকি ? কেমন করে করবে ?

লোকটি বলল, বাঁশি বাজিয়ে। আর এ জন্য আমাকে দিতে হবে এক হাজার সোনার মোহর।

টেবিল চাপড়ে মেয়র উঠে দাঁড়ালেন। উৎসাহে তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, এক হাজার কেন, দশ হাজার, বিশ হাজার, যা চাও তাই দেব। আগে ইঁদুর তাড়াও।

মিষ্টি হেসে লোকটা বলল – দেখবেন, কথাটা যেন ঠিক থাকে।

মেয়র বললেন – নিশ্চয়। বাজাও তোমার বাঁশি। মেয়রকে সালাম ঠুকে লোকটা হ্যামেলিনের রাস্তায় নেমে এল। ঝোলা থেকে সে বের করল সাপের মত আঁকাবাঁকা কুচকুচে কাল একটা বাঁশি। তারপর চারপাশটা দেখে নিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে মায়াবী সুর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। বাঁশি বাজছে, সুর উঠছে আর নামছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে, গর্ত থেকে, ভাঁড়ার থেকে, জুতোর ভেতর থেকে, টুপির মধ্য থেকে, বাক্স-বিছানা থেকে পিল পিল করে বেরিয়ে এল ইঁদুরবাহিনী। এল বাচ্চা ইঁদুর, ধেড়ে ইঁদুর, বুড়ো ইঁদুর, গোঁফওয়ালা ইঁদুর হাজার রকমের ইঁদুর। পড়িমরি করে তারা ছুটে এল রাস্তায়। ছুটতে লাগল বাঁশিওয়ালার পেছন পেছন ।

রাস্তার মানুষ, দোকানের মানুষ, অফিস-আদালতের মানুষ সবাই অবাক হয়ে দেখতে লাগল বাঁশিওয়ালার কাণ্ড। বাঁশি বাজাতে বাজাতে সে এগিয়ে চলল নদীর দিকে। ইঁদুরগুলোর কোন হুঁশ নেই একে অপরের পাশ কাটিয়ে, ধাক্কা মেরে তারা চলল বাঁশিওয়ালার পেছন পেছন। শহর পেরিয়ে বাঁশিওয়ালা এসে দাঁড়াল নদীর ধারে। হঠাৎ তার বাঁশির সুর গেল বদলে। সে অদ্ভুত রকমের একটা নতুন সুর তুলল বাঁশিতে। সেই সুর শুনে হাজার হাজার ইঁদুর লাফিয়ে পড়ল নদীর পানিতে। ঝুপঝাপ শব্দ শোনা গেল দূর থেকে।

ঢেউয়ের তোড়ে ইঁদুরগুলো ভেসে গেল অনেক দূরে। তারপর তলিয়ে গেল অথই পানিতে। থেমে গেল বাঁশির সুর।

বাঁশিওয়ালা হাতের বাঁশি রেখে দিল ঝোলার মধ্যে। তারপর এল শহরে, দাঁড়াল মেয়রের সামনে। বলল, শহরে আর একটাও ইঁদুর নেই। এবার আমার পাওনা মিটিয়ে দিন।

প্রাণখোলা হাসিতে মেয়র তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, ব্যস্ত হচ্ছ কেন ? ইনাম অবশ্যই পাবে। তা কত দিতে হবে?

পুরো এক হাজার সোনার মোহর। – ঠাণ্ডা আর কঠিন গলায় বলল বাঁশিওয়ালা।

মেয়র বললেন, এত বেশি কেন চাইছ বাপু ? আমি সারা মাসে এক হাজার মোহর বেতন পাই না। আর তুমি কয়েক মিনিটের জন্য চাইছ এক হাজার ? তাই কি হয় ? পঞ্চাশ মোহর দিচ্ছি, নিয়ে যাও।

এ কথা শুনে বাঁশিওয়ালার মাথায় যেন বাজ পড়ল। গম্ভীর হয়ে গেল তার মুখ।

মেয়র আবার বললেন, পঞ্চাশ মোহর কম কি ?

বাঁশিওয়ালা বলল, কম-বেশি বুঝি না। আমার এক হাজার মোহর চাই ।

কিন্তু মেয়র তার কথায় কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি বললেন, পঞ্চাশ মোহরই নাও। যদি তাতে না হয়, তবে কেটে পড়।

আপনি কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখলেন না। ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি— এ কথা বলে বাঁশিওয়ালা উঠে পড়ল ।

মেয়রের কক্ষ থেকে সে বেরিয়ে এল। রাস্তায় নেমে ঝোলা থেকে সে বের করল নতুন একটা বাঁশি। এটার রং রুপালি। চিকন সেই বাঁশিতে ফুঁ দিতেই এক অপূর্ব সুর বেরিয়ে এল। সে সুর ঢেউ তুলল শহরের বাতাসে। এমন মধুর মায়াবী সুরে বাজল বাঁশি – যা কেউ কখনও শোনে নি। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে হইচই পড়ে গেল। ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল হ্যামেলিনের খোকাখুকুর দল। আনন্দে নেচে উঠল তারা।

টুকটুকে, ফুটফুটে, দুষ্টু, শান্ত, চঞ্চল, মিষ্টি – সব রকমের শিশুই এল। নেচে গেয়ে লাফিয়ে তারা ছুটল বাঁশিওয়ালার পিছু পিছু। বাঁশির সুরে তখন ঘরছাড়ার ডাক।

লোকটা সোজা চলল শহর থেকে দূরে সেই নীল পাহাড়ের দিকে। লোকজন ভাবল, বাঁশিওয়ালা বুঝি তামাশা করছে। ছেলেমেয়েদের ফূর্তি দেখে তাই তারা হাসছিল। জাদুকর এলে শিশুরা তো এমনি করেই পিছু নেয়।

লোকটি কিন্তু এক বারও থামল না। বাঁশি বাজাতে বাজাতে পৌঁছে গেল পাহাড়ের কাছে। পথ ধরে চলল দ্রুতবেগে। শিশুদের নিয়ে এক সময় সে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল। সেই যে গেল আর ফিরে এল না।

হ্যামেলিনের হাসিখুশি শিশুরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল।

আলোচনা

ইতিহাসবিখ্যাত এ ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেকে যেমন ঘটনাটিকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, তেমনি যুক্তি দেখিয়ে অনেকেই চেষ্টা করেন ঘটনাটির সত্যতা প্রমাণের জন্য। আবার একে নেহাতই গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়ার লোকের সংখ্যাও কম নয়।

Postcard “Gruss aus Hameln” featuring the Pied Piper of Hamelin, 1902

দীর্ঘদিন অমীমাংসিত এই রহস্যের বিস্তর গবেষণা হয়েছে। হ্যামিলিন শহরের পৌরসভায় রাখা কাগজপত্র তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে এ ঘটনার কোনো সত্যতা আছে কি-না তা জানার জন্য। কিন্তু সেখানে এরকম কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হ্যামিলিন শহরে এ সংক্রান্ত একটি জাদুঘর রয়েছে। ওই জাদুঘরে সঞ্চিত পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা কয়েকটি বইয়ে এ রহস্যময় কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। সেখানে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেওয়া আছে। ফ্রাউ ভন লিউড নামের এক ১৩ বছরের বালক বলেছে, বাঁশিওয়ালার বয়স আনুমানিক ছিল ৩০। দেখতে ছিল অস্বাভাবিক রকম সুদর্শন। তার বাঁশিটি ছিল রুপার তৈরি। অন্য এক নথিতে পাওয়া যায় ১৩০০ শতাব্দীতে হ্যামিলিনের বাজারে এক কাঠের ফলক ছিল। সেখানে এক বংশীবাদক ও অনেক শিশুর ছবি ছিল। সেটা ১৭০০ সালে ঝড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। আরেকটি ঘটনায় হ্যামিলিন শহরে নিকোলাস নামের এক অসৎ ব্যক্তির বর্ণনা পাওয়া যায়। যে কি-না শিশুদের মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করে দিয়েছিল। অনেকে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার সঙ্গে এই ঘটনারও যোগসাজশ খোঁজেন। সেখানকার একটি রাস্তার নাম বাঙ্গেলোসেন্ট্রাস। যার অর্থ ‘যে রাস্তায় বাজনা বাজে না’। ওই রাস্তার একটি কাঠের ফলকে খোদাই করা আছে ১৮২৪ সালের ২৬ জুন হ্যামিলিনের ১৩০টি শিশুকে এক রংচঙা ব্যক্তি অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল যাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা গল্পে ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত শহরের কথা বলা হয়েছে। কেননা মধ্যযুগে ইউরোপে প্লেগরোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তখন ইঁদুর ধরার জন্য এক ধরনের বিশেষ লোক দেখা যেত। বিজ্ঞান বলে, হাই ফ্রিকুয়েন্সির শব্দতরঙ্গ দিয়ে ইঁদুরকে আকৃষ্ট করা যায়। হ্যামিলিনের জাদুঘরে একটি প্রাচীন টিনের বাঁশি রাখা আছে। ধারণা করা হয় প্রাচীনকালে ইঁদুর ধরিয়েরা এ ধরনের বাঁশি ব্যবহার করত। ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, ১২৮৪ সালে হ্যামিলিনে দুটি ঘটনা ঘটে। একটি হচ্ছে প্লেগ, অন্যটি নাচুনে রোগ। এক বিশেষ ধরনের খাদ্য বিষক্রিয়ায় এ রোগ দেখা দেয়। এতে রোগী ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাচতে থাকে। লাল রং তাদের আকৃষ্ট করত খুব। সাধারণত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাই এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। এ দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গল্পটির বর্ণনা দেন হ্যান্স ডোবারটিন। বর্তমানে হ্যামিলিনে যে পৌরসভা রয়েছে, তার নামের অর্থ হলো ‘ইঁদুর ধরা লোকের বাড়ি’। এটি নির্মিত হয় ১৬০২ সালে। এর দেয়ালে বিশ্ববিখ্যাত কাহিনীটির ছবি চমৎকারভাবে আঁকা আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *